আইনের জালেই অসাধু ব্যবসায়ীদের আটকাতে হবে
বাজারে দ্রব্যের দাম অস্বাভাবাবিক ভাবে বৃদ্ধি বা বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হলে ভোক্তাদের মনে প্রশ্ন জাগে দাম নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে কেউ কি কাজ করছেন? ছুটিতে বাংলাদেশে ছিলাম, বাজার সদাই করতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি বিষয়টি টের পেয়েছি। উপলব্ধি করেছি, দেশের মানুষ কেন কথায় কথায় বলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস।
এ ব্যাপারে লন্ডনে ফিরে একটু লিখবো লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। অর্থনীতিতে বাজার দর, চাহিদা যোগান, অস্থিতিশীল বাজার নিয়ে অর্থনীতি বিশেজ্ঞরা লিখেছেন। আমরা ভোক্তারা নিত্যপ্রয়োনীয় দ্রব্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে থাকলে খুশি, অন্তত খেয়ে বাঁচি মরি। অনার্স ডিগ্রিতে অর্থনীতি পড়েছি, অর্থনীতি সম্পর্কে অর্জিত সম্যক জ্ঞান আমাকে তাড়া করেছে প্রশ্ন করতে, কেন আমাদের বাজার দর নিয়ন্ত্রণহীন বা কথিত নাভিশ্বাস।
অর্থনীতি হলো, সামাজিক বিজ্ঞান যা পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন বণ্টন ব্যবহার অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। বা যে বিজ্ঞান সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ব্যবহার শ্রম, অর্থ, কর ইত্যাদি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে। বা অর্থনৈতিক বিবেচনায়, যা পণ্য এবং পরিষেবা তৈরি, বিতরণ, বিক্রয় এবং ক্রয় নিয়ে কাজ করে।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে আগুন। গরিব আছে সংকটে, মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। দেশে ভোক্তা অধিকার কেমন কাজ করছে তা জানার চেষ্টা করেছি। ২০২০ সালের একটি পরিসংখ্যান দৃষ্টিকটু হয়েছে, যা পড়ে মনে হয়েছে কেন আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রিণহীন। দেশে ভোক্তার অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। দেশের প্রায় ১৬ কোটি ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠানটির জনবল রয়েছে প্রায় ২০৮ জন। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে ১০৮ জন। শুধু রাজধানীর ২ কোটি ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে মাত্র ৫ জন কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবল না থাকায় প্রতিনিয়ত বাজার তদারকি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কোনো অভিযান পরিচালনার পর ফলোআপ করা সম্ভব হয় না। এতে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে ভোক্তা অধিকার। যার সুবিধা নিচ্ছে মুনাফাভোগী একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
২০২০ সালের বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসর্গ করা হয়েছিল, যার প্রতিপাদ্য- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার।’ এমন একটি বিশেষ দিবসকে জাতির জনকের নামে উৎসর্গ করার পাশাপাশি এই দিবসের সংশ্লিষ্টতা মানুষের জীবনকে যাতে অতিষ্ট করে না তুলে তার দায় দায়িত্বশীদের। উল্লেখিত রেফারেন্স পরিসংখ্যানটি ২০০০ সালের বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস থেকে সংগ্রহীত। জানি না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ যাবত তাদের জনবল বৃদ্ধি করেছে কি না? আমার বিশ্বাস জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে লোকবল সংযোজনসহ উত্থাপিত সমস্যার আশু সমাধান হয়েছে।
অর্থনীতির ভাষায় চাহিদা এবং যোগান বলতে কোন একটি পণ্যের বা সেবার ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বিদ্যমান বাজার সম্পর্ক বোঝায়। বাজারে কোন পণ্যের দাম এবং সরবরাহ কী-রূপ হবে তা চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ক দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সভ্য সমাজে কোন বিশেষ উপলক্ষ বা উৎসবকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমতে দেখা যায় বা স্থিতিশীল থাকে। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশে। পবিত্র রমজান বা অন্য কোনো উৎসব উপলক্ষ সামনে রেখে আমাদের বাজারে দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন শুরু হয়। আমাদের দাম বাড়ানোর কারণ অজুহাত মেলা।
যুক্তরাজ্যে মাহে রমজানকে সামনে রেখে সুপার মার্কেটগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যে, যেমন- চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, সেমাই, ঘি, এসব পণ্য দ্রব্যগুলোতে বিশেষ মূল্যছাড়ের (discount) ব্যবস্থা থাকে। যেমন ধরেন, মাহে রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়ে ২০ কেজি ওজনের এক বস্তা বাসমতি চালের দাম ২০ পাউন্ড থেকে ৫০% মূল্যছাড় দিয়ে ১০ পাউন্ড রাখা হয়। আমাদের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা উদ্বেগজনক। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় ভোক্তারা প্রতিনিয়ত কেবল ঠকছেনই না; একইসঙ্গে তাদের সিন্ডিকেটবাজির কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে।
দ্রব্যের দাম ক্রমাগত কেন বাড়ছে। এতে সরকারের ভূমিকা কি? আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব কতটুকু আর ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কতটুকু। দাম বাড়ার ফলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা গবেষণা হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।
যে কোনো স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থায় সর্বত্রই একধরনের সিন্ডিকেটের প্রভাব লক্ষণীয়। সিন্ডিকেট চক্র কিছুদিন পর পর যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে। মজুত, সিন্ডিকেট বা কোনো অনৈতিক উপায়ে কেউ যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকারের যথাযথ মন্ত্রণালয়কে নিতে হয়। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দাবিকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকারকে সর্বোচ্চ যৌক্তিক অবস্থান নিতে হয়। দাম বাড়ানোর কারণগুলো যথাযথভাবে ভোক্তাদের অবহিত করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে সময়ক্ষণে অনৈতিকতার কৌশলে বাজারকে অস্থিতিশীল করেন আইন সংশোধন করে কঠোর তাদের শাস্তির বিধান করতে হবে।
পণ্যদ্রব্যের দাম নিজ থেকে বাড়ে না, বাড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে পণ্যের দাম অপরিবর্তিত। এমনকি দেশে বাম্পার ফলন হলেও পণ্যদ্রব্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে থাকে না। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজারের ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতি ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ভূমিকা উপেক্ষণীয়। সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর কিছু করছে না। তাই সাধারন ভোক্তারা মনে করছি আমাদের বাজার নিমন্ত্রণ কাঠামো দুর্বল।
সৎপথে থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করে বড় মুনাফা সম্ভব নয় ইহা আমাদের সমাজে ব্যবসায়ীদের একটি ভ্রান্ত ধারণা। এসব ভ্রান্ত ধারণার জন্য আমাদের ব্যবসায়ীদের ইমেজও খুব একটা ইতিবাচক নয়। চোরাপথে পণ্যদ্রবই ক্রয়, শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠকা, ভেজাল নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ ,ওজনে কম , মজুতদারি, দাম বাড়িয়ে ও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তাড়াতাড়ি বড়লোক হবেন এমন ধারণা শুরু থেকেই তাঁরা পোষণ করেন যা তাদেরকে অনৈতিকতার পথে প্ররোচিত করে।
দেশে মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও আছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সরকার দোষারোপ করেন ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা বলেন, উৎপাদন কম হওয়া,পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেই মূল্যবৃদ্ধির কারণ।
অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাজারে চাহিদা ও জোগানের ওপর দব্যমূল্য নির্ভর করে; কিন্তু এ সংজ্ঞা বাংলাদেশে ফেল করেছে। বাংলাদেশে অর্থনীতির কোন সংজ্ঞাই কাজ করছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের জন্য সীমিত পরিসরে শুধু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও জরিমানা করা হচ্ছে, যা পর্যাপ্ত না। আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জনবল বাড়িয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। নকল ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে প্রান্তিক পর্যায়ে তদারকি করতে হবে। শহরে নিবিড় মনিটরিংয়ের কারণে ভেজালের আগ্রাসন অসাধু ব্যবসায়ীরা গ্রামগঞ্জে নিয়ে গেছে। এজন্য উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অফিস প্রয়োজন, যাতে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা যায়। তা না হলে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের প্রতারিত করেই যাবে।
ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবে এটাই স্বাভাবিক। অর্থনীতি বলে, পণ্য দ্রব্যের দাম বাড়লে মানুষের চাহিদা কমে ,আর দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। তবে এই সূত্র একটা বিশেষ সময়ে বাংলাদেশের অকার্যকর হয়ে পড়ে। যেমন ধরেন, রামাদান মাস এই সময়টাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন যারা সময়ের সুযোগ নেয়।
পাইকারি খুচরা আড়তদার যে সকল ব্যবসায়ী আছে তারা প্রায় সকলেরই লম্বা দাড়ি, দাড়ির মধ্যে আবার কালার, নামাজ পড়তে পড়তে অনেকেরই কপালে কালো দাগ, তবে তাদের নীতি নৈতিকতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে! ১৭ কোটি লোকের বসবাস এই দেশে। মন্ত্রী মহোদয় বাজারে গিয়ে বাজার দর মনিটরিং করবেন এটা কেমন করে সম্ভব বলুনতো? যুগোপযোগী ও যথাযথ আইন প্রয়োগ করুন, যে আইন আছে সেটাকে আমেন্ডমেন্ট করার প্রয়োজন হলে আমেন্ডমেন্ট করুন। আইনের জালেই অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে আটকাতে হবে।
বাজারদর মনিটরিং ও অভিযোগ এর জন্য একটা হট লাইন নাম্বার দেওয়া হয়েছে। মহাজন কোন কোন পণ্যদ্রব্যে বেশি দাম নিয়েছেন recipt চেক করে ক্রেতা দোকানে থেকেই সরাসরি হটলাইনে ফোন দেবে, ভ্রাম্যমান আদালত instantly সেখানে চলে আসবে, ক্রেতার অভিযোগকে খতিয়ে দেখবে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর অনুরোধ করবেন। এই সময়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বিষয়টি সমাধান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত । অপরাধের ধরন বিবেচনায় প্রয়োজনে দোকানকে সিলগালা করে রাখবেন। ঘটনার সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষে প্রত্যেকটি জেলায় ৪০/৫০ টা দোকানকে সিলগালা করতে পারলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা তারের মতো সোজা হয়ে আসবেন।
আমাদের দেশের লোকজন একটু কঠিন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তাই আইনের প্রয়োগে একটু কঠিন tough হতে হয়।
লেখক : জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন। মেম্বার, দ্য ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।
২২ মার্চ ২০২৪, ১৫:১৪