ফিরে দেখা ২০২৪
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতন
দেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। মূলত, কোটা প্রসঙ্গে ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলনের সূচনা; যে আন্দোলনের গোড়াপত্তন ২০১৮ সালে। ’১৮-র দুর্বার আন্দোলনে সরকার কোটায় ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা দেয়। সে সময় ছাত্ররা ঘরে ফিরলেও চব্বিশে ফের সরকার বেঁকে বসলে ছাত্ররা নাছোরবান্দা। ‘হয় ধান, নয় প্রাণ—এ শব্দে সারাদেশ দিশেহারা’ সুকান্তের কবিতার চরণের সাথে সুরমিলিয়ে ছাত্ররাও বলেছিল—‘হয় অধিকার, নয় প্রাণ’। ধীরে ধীরে রাজপথ প্রকম্পিত হতে শুরু করে। মিছিলের প্রতিটি হাত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—ভাঙব, মচকাব না। সরকারও মরিয়া ছাত্রদের ঘরে ফেরাতে, হলে ফেরাতে। ধীরে ধীরে নরম সুর চরমে ওঠে সরকারের। বিক্ষোভের অনলে ঘি ঢালেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের উদ্দেশ করে উচ্চারণ করেন ‘রাজাকারের নাতিপুতি’। ‘হঠাৎ নিরীহ মাটিতে জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান’, উত্তাল গোটা দেশ।
সরকারি চাকরিতে এই কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবি। মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সক্রিয়ভাবেযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ডান ও বামের কোনো ভেদাভেদ ছিল না, গণঅভ্যুত্থানে সবাই ছিলেন এক দাবিতে, সেটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।
আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ জুন। কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন হাইকোর্ট ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের একটি অংশ (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) অবৈধ ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়। ২০১৮ সালের আগে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। শিক্ষার্থীরা তখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেদের বশে পুরো কোটাই বাতিল করে দেন।
এবার শিক্ষার্থীরা যখন শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছিলেন, তখন শেখ হাসিনা একটি বক্তব্য দেন। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? (চাকরিতে কোটা) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরাও পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে, সেটা আমার প্রশ্ন।’ তার এই মন্তব্যের পর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসেন ছাত্রছাত্রীরা। তারা দাঁড়িয়ে যান শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থানে, যেটা এর আগের ১৫ বছরে হয়নি।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সেদিন রাতের মিছিলে ক্ষোভ থেকে প্রথমে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়। পরে স্লোগানে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়, বলা হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। ওই দিন মধ্যরাতে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী। শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর রাত তিনটায় ক্যাম্পাসে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ।
শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে মানুষের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল আগেই। ক্ষোভের সেই বারুদে স্ফূলিঙ্গের মতো কাজ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা (১৫ জুলাই) এবং পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শহীদ হওয়া (১৬ জুলাই)। আবু সাঈদকে গুলি করার ভিডিও চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল গুলি করে। কিন্তু মানুষ বুক পেতে দিয়েছেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিয়নশিল্পী, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিক—সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার আর টিকতে পারেনি।
সেনাবাহিনীও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দলটি। নেতাকর্মীদের কেউ কেউ কারাগারে বন্দি হলেও গা ঢাকা দিয়েছেন অনেকে।
কোটাপ্রথা পুনর্বহাল
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫৬ শতাংশ কোটা ও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো করেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারতেন না।
এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে প্রথম কোটাপ্রথা বাতিল করে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সাত জানুয়ারির নির্বাচনের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। সরকারি চাকরিতে আগের মতোই কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করা হয়।
গেল ১৪ জুলাই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন।
রায়ে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনির কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। একইসঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ, যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
শুরুতে সরকার পতনের লক্ষ্য ছিল না
এই আন্দোলনের শুরুটা সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে হয়নি। শিক্ষার্থীরা সরাসরি সরকারবিরোধী স্লোগানও দেননি। তবে দাবির ব্যাপারে একটা অনড় অবস্থান ছিল।আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রলীগ সংগঠিতভাবে বাধা দেয়নি। শুধু আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে তারা মধুর ক্যানটিনে অবস্থান নিত। তবে হল পর্যায়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, হুমকি দিয়েছেন।
১৩ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পরদিন শেখ হাসিনার ‘অপমানজনক’ মন্তব্য পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’, তখন থেকে ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তব্যও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সেদিনই ছাত্রলীগ আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের হাজির করে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাই রাতে রোকেয়া হল থেকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিতাড়িত করেন।
এ ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ জুলাই দুপুরের মধ্যে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের নিয়ন্ত্রণ নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
যদিও অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশি অভিযান চালিয়ে ১৭ জুলাই সন্ধ্যার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও হল ছেড়ে যাওয়ার সময় নীলক্ষেত ও শাহবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীদের মারধর করেছিল ছাত্রলীগ। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্রলীগের প্রতি ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর ঢাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সরকারি চাকরি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তেমন আগ্রহ থাকে না। কিন্তু তারা রাস্তায় নেমেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে। গড়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ববোধ।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড
১৬ জুলাই বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ, যে ফটকটি পরে ‘শহীদ আবু সাঈদ গেট’ নামকরণ করেন শিক্ষার্থীরা। আবু সাঈদ সেখানে একা দুই হাত প্রসারিত করে, বুক পেতে পুলিশ থেকে ৫০-৬০ ফিট দূরে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে ছিল কেবল একটি লাঠি। এরপরও তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরই আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে।
আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। অত্যন্ত দরিদ্র বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের একজন ছিলেন সাঈদ। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ও মেধাবী। পরিবারের মধ্যে প্রথম কোনো ব্যক্তি হিসেবে যখন তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন, তার ভাইবোনরা এতই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে নিজেদের পড়াশোনার খরচ বাঁচিয়ে তাকে দিতেন।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যা
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণ-অভুত্থানের সময় সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডকে ‘জুলাই গণহত্যা’ বলা হয়। বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল ও ব্যাপক গণ-অসন্তোষের জের ধরে এই দমন অভিযান পরিচালনা করে তৎকালীন সরকার, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জুলাই বিপ্লবে অন্তত ১ হাজার ৪২৩ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম। গেল ২১ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে তিনি আরও বলেন, শহীদ এবং আহতদের সংখ্যায় আরও কিছু সংযোজন-বিভাজন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে খুব শিগগিরই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। এত প্রাণহানি সত্ত্বেও হাসিনা সরকার এই গণহত্যার দায় অস্বীকার করে এবং সহিংসতার জন্য অন্যান্য কারণকে দায়ী করে।
একদফা দাবিতে আন্দোলন
৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনটির সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে।
পরে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন নাহিদ। তিনি বলেন, সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন।
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, শিল্পী গোষ্ঠী, শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু সারা দেশের মানুষ সমর্থন যোগান। একটি সংবাদ সম্মেলনে দেশের সাবেক সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় না করানোর আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে অসহযোগ কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বলা হয়, সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেইসঙ্গে অনির্দিষ্টকালের কারফিউও বহাল রাখা হয়।
এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’র ঘোষণা দেন। কিছু সময় পর সেই কর্মসূচি ৫ আগস্টের জন্য ঘোষণা দেন সমন্বয়করা। সারাদেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং গণ-অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন। অন্যদিকে কঠোর হাতে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করতে ৪ আগস্ট দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৪ আগস্ট দুপুর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ
৫ আগস্ট সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। তবে দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণের ঘোষণা দেন। তখনই রাজধানীর বুকে ছাত্র-জনতার ঢল নামে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া লাখো মানুষের সমাবেশ বেলা আড়াইটার দিকে যাত্রা করে গণভবনের দিকে। এরপর জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
সেনাপ্রধানের ভাষণের পরই উচ্ছ্বসিত ছাত্র-জনতার মিছিলে মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘কী হয়েছে কী হয়েছে, শেখ হাসিনা পালাইছে’। ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করল। যার জন্য শেষদিন পর্যন্ত সময়কে ‘৩৬ জুলাই’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে ছাত্র-জনতা।
অভ্যুত্থানের পরে
সমন্বয়ক দল (টিম) বিলুপ্ত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ২২ অক্টোবর। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে হাসনাত আবদুল্লাহকে। অন্যদিকে আন্দোলনে থাকা তরুণেরা গঠন করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৬২ সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। নাগরিক কমিটি বলছে, তাঁদের স্বপ্ন, বাংলাদেশকে একটি ‘শক্তিশালী রাজনৈতিক দল’ উপহার দেওয়া।
মন্তব্য করুন