ঢাকাশনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আম্পান: যশোরে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অনেকে, ২৮৩ কোটি টাকার ক্ষতি

বি এম ফারুক, যশোর

মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০ , ০৭:৩৩ পিএম


loading/img
আম্পান: যশোরে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অনেকে

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের প্রায় এক মাস হতে চললেও জেলায় বিভিন্ন এলাকায় বহু মানুষ এখনো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেননি। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় এখনো আশ্রয়হীন কয়েক হাজার মানুষ। এখনও বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা। সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে যশোরেই সবচেয়ে বেশি ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার। 

বিজ্ঞাপন

ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালা, কাঁচা পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের খুঁটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আঘাতের প্রায় এক মাস পার হলেও সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি জেলার মানুষ। হাজারো মানুষ এখনো আশ্রয়হীন। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি সামালে ঘুরে দাঁড়ানোই মানুষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের দাবি, আম্পানের আঘাতে যশোর জেলা ২৮৩ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিপুল ক্ষতির বোঝা সামলে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোয় বড় চ্যালেঞ্জ।

বিজ্ঞাপন

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস মতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মণিরামপুর, শার্শা, অভয়নগর, কেশবপুর ও চৌগাছায় উপজেলায়। জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৮৩ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গাছ উপড়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত আরও অর্ধশতাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ২১৭জন মানুষ। ১৫ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমির ফসলহানি ও ৬৪ হেক্টর বীজতলা নষ্ট, ৩৩ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক  লাখ ৬৭ হাজার ৫শ’ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সেক্টরে ১৩২ কোটি ১২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৩২ হেক্টর মাছের পুকুর ও খামারে দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

জেলায় বিদ্যুৎ লাইনের সম্পূর্ণ ক্ষতি ১৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও আংশিক ১৫৬ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন। ক্ষতির পরিমাণ ২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। 

জেলার ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি, ১৫৯টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও ৭৬টি মাদরাসায় ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৫৫০টি গভীর নলকূপের তিন কোটি ৭১ লাখ টাকা। জেলায় অগভীর নলকূপ এক হাজার ২২০টি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৯৮ লাখ টাকা। হস্তচালিত নলকূপ ২৫টির ৬ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

বিজ্ঞাপন

এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের ১৫টি মোবাইল টাওয়ারে ১৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৩৮৪টি মসজিদে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ও ৯৬৬টি মন্দিরে ১৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩০টি গির্জায় ৮৫ হাজার ক্ষতি হয়েছে। 

বিজ্ঞাপন

যশোর জেলায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া ১১টি ব্রিজ কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। 

৬ হাজার ৭৯৭টি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট, বিভিন্ন পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। একটি ক্লিনিক ও আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। 

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বারাকপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত। কৃষিতেই তার জীবন জীবিকা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তার ক্ষেতের দুই বিঘা পেঁপে, এক বিঘা করলা, ২৫ কাঠা জমির তিল ও দুই বিঘা জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবো কি করে ভাবতে পারছি না। 

কৃষক যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের হারুন অর রশিদ বলেন, সাড়ে তিন বিঘা জমির লিচুর সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে ঝড়ে। সঙ্গে লাউ, উচ্ছের মাচাও উলটপালট করেছে। লিচুতেই আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। লিচুর ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে। এসব ক্ষতি থেকে কৃষকদের কাঁটিতে তুলতে সরকারের সাহায্য কামনা করেছেন তিনি। 

চৌগাছার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা হারুন কবীর রুবেল বলেন, ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কলা পেঁপে ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ে কলা ও পেঁপের ক্ষেত সব নষ্ট হয়েছে। আশা করেছিলেন ১০ লাখের উপরে লাভবান হবো। এখন উল্টো দেনায় পড়েছি। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বোরো ধানের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিছু ধানের বীজতলা ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কাজ শেষে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। সরকারি সহায়তা পেলে তালিকায় অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।

মৎস্য অধিদপ্তর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হ্যাচারি ও চাষিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাহায্য করা হবে।

এ ব্যাপারে যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির- ২ জেনারেল ম্যানেজার অরুণ কুমার কুন্ড বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে ৩০২টি বৈদ্যুতিক পে ভেঙে যায়। বৈদ্যুতিক লাইনের পিলারের তার ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। দিন রাত কর্মীরা ছুটে চলছেন ভেঙে পড়া বিদ্যুতের মেরামতের কাজে। 

এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় বিদ্যুৎ যায়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু ক্রুটিপূর্ণ কারণে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। সব গ্রাহকই দ্রুত বিদ্যুৎ পেয়ে যাবেন। 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান, আম্পানের আঘাতে যশোরের ৮টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়ন এলাকায় কম বেশি ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে যশোরের ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। কিছু এলাকায় ঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে যশোরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক লোক। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আট উপজেলায় টিন বিতরণ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভেঙে যায় ঘর ঠিক করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ বান টিন বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া খাদ্যসহায়তা হিসেবে ১০০ মেট্রিকটন চালও বিতরণ হচ্ছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের পরে এসব ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩শ বান বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি টিনের বানের সাথে ৩ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে চাহিদা পাঠিয়েছি।

এসএস

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |