ঢাকাশুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাবার ছেঁড়া ব্যাগটির অপেক্ষায় মেয়ে

মো. আবু সালেহ মুসা

শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬:৫৮ পিএম


loading/img

বাড়িতে কেউ আছেন মাগো? কয়ডা (কয়টা) ভিক্ষা দেন। হঠাৎ এমন ডাকে জেগে উঠলাম। আমি তখনও ঘুমাচ্ছিলাম। যদিও বেলা তখন ১১টার কাছাকাছি। যাই হোক বাহিরে নেমে দেখি- কাঁচুমাচু হয়ে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। বয়স (অনুমান) ১০০ পেরিয়ে গিয়েছে। শীতে কাঁপছে। কিন্তু শরীরে কোনো শীতের পোশাক নেই, শুধু জোড়াতালি দেওয়া একটি পাঞ্জাবি পরা।

বিজ্ঞাপন

জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কাকে চান? বলল, কাউরে (কাউকে) না বাজান, ভিক্ষার লইগা (জন্য) আইছি (আসছি)। কয়ডা (কিছু) ভিক্ষা দেবেন? বললাম, দাঁড়ান, নিয়ে আসি। এরপর ঘর থেকে কিছু চাল নিয়ে আসলাম লোকটির জন্য। এরপর চাল নিয়ে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আহা! বেচারা নিজেই হাঁটতে পারছে না আবার ভিক্ষা করছে।

আমি ঘরে ঢুকব এমন সময়, আবার আমার দিকে ফিরে আসতেই, আমি দাঁড়ালাম। ভাবলাম কিছু ফেলে গেছে হয়তো। এরপর কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসি দিয়ে বলল, বাজান একখান (একটি) কথা কমু (বলব) আমনে (আপনি) কি রাগ কইরবেন (করবেন)? না চাচা, বলেন। 

বিজ্ঞাপন

বাজান দুগ্গা (কয়টা) ভাত খাওয়াইবেন (খাওয়াবেন), এহনও (এখনও) কিছু খাই নাই।

আমি অবাক হয়ে বললাম, এত বেলা হয়েছে এখনও কিছুই খাননি? বলল, সকালে দুগ্গা (অল্প) পান্তাভাত আছিল, কিন্তু তা নাতিডায় (নাতি) খাইয়া (খেয়ে) ফালাইছে (ফেলছে)। ঘরেও আর চাউল (চাল) আছিলো না। শুনে একটু খারাপ লাগল। বললাম, আচ্ছা ঘরে উঠে বসেন, খাবার দিচ্ছি। শুনে খুশি হলো। আমি আম্মুকে খাবার দিতে বললাম।

সেদিন ঘরে তেমনকিছু ছিল না। আলু আর ছোটমাছ। তাই দিয়েই খেতে দিলাম। খেতে খেতে বলল, বাজান মরিচ আছে? আছে। মরিচ এনে দিলাম। খাবারের গতি দেখে যতটুকু বুঝলাম- তরকারি থেকে মরিচেই তার রুচি বেশি। কিন্তু তার কাপুনির বিষয়টিও আমার নজর এড়ালো না।

বিজ্ঞাপন

একবার ভাত মুখে দিতে ১০ বার চেষ্টা করতে হয়। যখন পানি খায়, তখন গ্লাস আর দাঁতের সঙ্গে ছোট ছোট আঘাতের কারণে খটখট শব্দ হয়। এমন আরও কিছু বিষয় আমার নজর পড়ে। এসব দেখে তার বিষয়ে জানতে আগ্রহী হলাম। এর মধ্যেই তাকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম।

বিজ্ঞাপন

তার নাম তজুমুদ্দিন (ছদ্মনাম)। তার হিসেবমতে বয়স ১০০ পার হয়েছে অনেক আগেই। শরীরে ভর করেছে নানান রোগ। স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন। মা মারা যাওয়ার পর ছেলেরা বাবার কোনো খোঁজ নেয় না। তাই চাচার ঠাঁই হয়েছে মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু মেয়েরও অভাবের সংসার।

কিছুদিন আগে তারও স্বামী মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে থাকার জায়গাটুকু ব্যতীত কিছুই রেখে যাননি। আছে দু-চারটি হাঁস-মুরগি, তার ডিম বিক্রি করেই চাল-ডাল কেনে। দশ বছর বয়সী একটি ছেলে আছে তার। তাই এক দিন খেতে পারলেও পরেরদিন না খেয়ে থাকে। এ ভাবেই দিন কাটছে তাদের। এমনই অনাটনের মধ্যে আবার ঠাঁই দিয়েছেন বাবাকেও।

বয়সের কাছে তজুমুদ্দিন হার মেনে গেছে। এখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না। ফলে উপায় না পেয়ে ভিক্ষা শুরু করে। অভাবের তাড়নায় মেয়েও তার অচল বাবাকে ভিক্ষা করতে নিষেধ করেনি। তাই তজুমুদ্দিন এখন অসুস্থ শরীরে ভিক্ষা করে বেড়ান। এখন দিন শেষে যা পায়, তা দিয়ে দুবেলা চলে তাদের।

জিজ্ঞেস করলাম, সরকারি কোনো অনুদান পান না? বলল, বয়স্ক ভাতায় একখান নাম আছে। অনেকদিন পরপর ১ হাজার টাহা (টাকা) পাই, কিন্তু তা দিয়ে ওষুধই খাইতে হয়। বেশি অসুস্থ হইলে তো আর ভিক্ষাও করতে পারমু না। মাইয়া (মেয়ে) আর নাতিডা (নাতি) আমার দিকে চাইয়া (চেয়ে) থাহে (থাকে)।

চাল নিয়া বাড়ি ফিরলে রান্ধন (রান্না) হয়। তারপর সবাই একসঙ্গে খাই। মুই তো (আমি তো) সকাল দুপুর মাইনষের (অন্যের) বাড়িতে খাই, কিন্তু অরা (তারা) প্রায়দিনই থাহে (থাকে) না খেয়ে। চাচা এইভাবে আর কতদিন চলবে? বলল, কিছু তো আর করার নাই বাজান। যদ্দিন (যতদিন) বাঁইচ্চা (বেঁচে) আছি এমন কইরাই (করেই) চলতে হইব (হবে)।

কথা বলতে বলতে চাচার খাবার শেষ হলো। এরপর দুহাত ওপরে তুলে আমাদের জন্য দোয়া করলেন। এবার যাওয়ার পালা। আমি তখন তাকে ১০০ টাকা দিলাম। টাকা দেওয়ার পর আমায় বলল, বাজান ‘ভিক্ষা খুবই খারাপ কাজ’।

আল্লায় (আল্লাহ) যেন এমন খারাপ কাজে কাউরে (কাউকে) আর না আনে। সব বাড়ির মানুষ এক না। অনেক বাড়ির মানুষ গালিও দেয়, ভিক্ষা করে খাই ক্যান (কেন) তাই। বলেই কাঁদতে শুরু করে। কান্না দেখে তার দিকে তাকিয়ে, আর কিছু বলতে পারলাম না। 

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলেন। মাঝে মধ্যে একহাত দিয়ে চোখ মুছছিল, আর অন্যহাতে ছেঁড়া ব্যাগটি ছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে ঢুকি। ঘরে ঢুকতেই দেখি মায়ের চোখে পানি। আমি বুঝতে পারলাম, মা ওপাশ থেকে আমাদের সবকথা শুনেছেন। আমার দেখে চোখ মুছতে মুছতে মা বলল, বাবা-মা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সন্তানদের বটবৃক্ষের মত ছায়া দেয়। কারণ, সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা ঠিক কতটা, তা আল্লাহই জানেন। বাবা-মায়ের কাছে তার সন্তানের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে খাবারের অভাবে যদি সেই বাবা-মাকে ভিক্ষার থালা হাতে নিতে হয়, তাহলে তার থেকে কষ্টের আর কিছু হয় না। ওই বৃদ্ধর চোখের পানি দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল।

আমি মায়ের কথাগুলো মন থেকে অনুভব করতে পারি। তাই আর কিছু বলিনি। চুপ করে রুমে চলে আসি। আমি ভাবছি তজুমুদ্দিনের মেয়ের কথা। সে এখনও বসে আছে বাবার ছেঁড়া ব্যাগটির অপেক্ষায়।

লেখক: মো. আবু সালেহ মুসা

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |