• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৪ ভাদ্র ১৪৩১
logo

বাঘিনীদের ফুটবল ইতিহাস এবং স্বপ্নবাজদের সাফ জয়

  ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৩৮
ছবি : আরটিভি নিউজ

‘যে পা রাঙা আলতা মাখে, সে পা ফুটবলও খেলে’- ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে নারীদের ফুটবলের সূচনার পরের বছর তাদের নিয়ে এভাবেই লিখেছিলেন পাক্ষিক ক্রীড়াজগতের ক্রীড়া সাংবাদিক সালমা রফিক। সেই থেকে বাংলাদেশে নারীদের ফুটবলের জাগরণের সর্বোচ্চ চূড়া খুঁজে পেতে সময় লেগেছে ৪০ বছরেরও বেশি সময়।
অবশেষে বিদায়ী ২০২২ সালে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে সাবিনা খাতুন, সানজিদা ইসলাম, রুপনা চাকমাদের হাত ধরে প্রথম কোনো বড় শিরোপা নিজেদের করে নিতে পেরেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। যা নারীদের জন্য এবং সমসাময়িক বাংলাদেশের ফুটবলের জন্যই সবচেয়ে বড় সাফল্যের ঘটনা। নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোল ব্যবধানে হারিয়ে পুরো দেশের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল প্রয়াত কোচ সাহেব আলীর হাত ধরে। ১৯৭৭ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মেয়েদের নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন ফুটবল দল। যাদের নিয়ে অনুশীলনও করেছিলেন তিনি। তবে বড় কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। এরপর লম্বা সময় আবারও ঝিমিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল যাত্রা।
অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ২০০৪ সালে বয়সভিত্তিক দল দিয়ে আবারও বাংলাদেশের নারী ফুটবলের যাত্রা দেখা যায়। এই চেষ্টায় অবশ্য সফলতার সঙ্গেই উতরাতে থাকে বাংলাদেশের নারী ফুটবল। বয়সভিত্তিক দলের আত্মপ্রকাশের ৫ বছর পর ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো নারীদের জাতীয় ফুটবল দলের জন্য পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। এরপর বছর না পেরোতেই ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলাঙ্গনে পা রাখতে পারে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখলেও সাফল্য যেন ধরা দিচ্ছিল না নারীদের জাতীয় দলে। তবে কোনোদিনও কোনো মুহূর্তের জন্যও আশা হারাননি নারী দলের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন। তার এই চেষ্টা চলতে থাকে জাতীয় দল থেকে শুরু করে নারীদের বয়সভিত্তিক দলগুলো ঘিরেও। আশার আলো হয়ে মাঝে মাঝেই বয়সভিত্তিক দলগুলোর সাফল্য কোচ ছোটনকে সামনে এগোনোর রসদ জোগাতে থাকে।
এরমধ্যে নারী ফুটবল দলকে আরও সুসংহত করে গড়ে তোলার জন্য দেশব্যাপী ফুটবলার খুঁজতে থাকেন গোলাম রাব্বানী ছোটন। তখনই প্রথমবারের মতো আলো কেড়ে নেয় ময়মনসিংহের বন্ধুর পথ পেরোনো কলসিন্দুর গ্রাম। যেখান থেকে উঠে আসে এক ঝাঁক ফুটবলার। যারা আশা দেখাতে থাকে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে।
২০১৫ সাল থেকে বয়সভিত্তিক দলকে বিভিন্ন অঙ্গনে সাফল্য এনে দিতে থাকে ফুটবলাররা। ২০১৫ সালে নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যার শুরু। একই দল পরের বছর তাজিকিস্তানেও একই শিরোপা নিজেদের করে নেয়। বয়সের সঙ্গে দলটির ফুটবলাররা যখন পরবর্তী পর্যায়ে যেতে থাকে তখনই বয়সভিত্তিক দলের ক্ষেত্রেও নতুন করে সাফল্যের পালক যুক্ত হতে থাকে।
একে একে বয়সভিত্তিক দলের সব পর্যায়ে সাফল্যের গল্প লিখতে থাকে নারীদের ফুটবল দল। যেখানে বয়সভিত্তিক সাফ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কীর্তি গড়ে গোলাম রাব্বানী ছোটনের শিষ্যরা। কিন্তু জাতীয় দলের সাফল্যের খেরো খাতাই যেন খোলা যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। তবুও সকল বাধা-বিপত্তির মধ্যেই ২০১৬ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স আপ হয়ে জাতীয় দলও সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর রেখার ইঙ্গিত দিয়েছিল বটে।
তবে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলো খুঁজে পেতে বাংলাদেশের নারী জাতীয় ফুটবল দলকে অপেক্ষা করতে হয় পাক্কা ৬ বছর। সেই একই টুর্নামেন্ট সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে। এই টুর্নামেন্টের ষষ্ঠ আসর খেলতে বাংলাদেশসহ মোট ৭ দল নেপালে অবস্থান করে। যেখানে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকে ভারত, পাকিস্তান এবং মালদ্বীপ।
গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বাঘিনীরা রীতিমতো উড়তে থাকে। তিন ম্যাচে মাঠে নেমে তিনটিতেই জয়ে শেষ করে। এরমধ্যে তিন ম্যাচে গোল দেয় মোট ১২টি। বিনিময়ে একটি গোলও হজম করতে রাজি হয়নি বাঘিনীরা। এরমধ্যে আসরের ফেভারিট ভারতের জালেও তিনটি গোল দেয় বাঘিনীরা। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভোগায় পাকিস্তানকে। তাদের জালে অর্ধ ডজন গোলের উৎসবে কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানকে।
গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়ে প্রতিপক্ষ ভূটানকে নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে ওঠেন বাংলার বাঘিনীরা। অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের হ্যাটট্রিকের সঙ্গে আরও চার ফুটবলারের গোলে সেমিফাইনালে ভূটানকে ৮-০ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় বাঘিনীরা। রেড হট ফর্ম নিয়েই ফাইনালে জায়গা করে নেয় ছোটনের শিষ্যরা।
যেখানে শিরোপার লড়াইয়ে দশরথ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে আসে স্বাগতিক নেপাল। তবে আগুনে ফর্মে থাকা বাঘিনীদের সামনে ফাইনালে প্রতিরোধই গড়তে পারেনি নেপালিজ নারী ফুটবলাররা। দলটির সাফল্য বলতে পুরো আসরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জালে একটি গোল দিতে পারা।
খেলার ৭০তম মিনিটে নেপালের পক্ষে সেই গোলটি করে আনিতা বাসনেট। তবে তার আগেই খেলার ১৪ এবং ৪৪তম মিনিটে দুই গোল দিয়েই এগিয়ে যায় বাঘিনীরা। বাংলাদেশের পক্ষে সেই গোল দুটি করেন যথাক্রমে শামসুন্নাহার জুনিয়র এবং কৃষ্ণা রাণী। এদিকে নেপাল এক গোল দেওয়ার ৭ মিনিট পর খেলার ৭৭তম মিনিটে আরেক গোল করে বাংলাদেশের বুকে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেন গোলাম রাব্বানী ছোটনের প্রিয় বাঘিনীরা।
বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক অর্জনে আবেগের বন্যা বইয়ে যায়। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বুকে সাফল্য উদযাপন করতে বাইরের দেশের মতো ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করা হয়। যা এয়ারপোর্ট থেকে বাঘিনীদের নিয়ে ভক্ত-সমর্থকদের ভালোবাসা নিয়ে যায় বাফুফে ভবনে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আনন্দ উদযাপনের সময় রাস্তার পাশে ব্যানারের সঙ্গে আঘাত পেয়ে চোটে পড়েন ঋতুপর্ণা।
বাঘিনীদের এই ঐতিহাসিক সাফল্যে খুশি হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সমাজের উঁচু শ্রেণী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একের পর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। কেবল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নয় ভাগ্য বদলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বাঘিনীরা জিততে থাকেন বড় অঙ্কের টাকাও।
তবে সেই আনন্দের মুহূর্তেই পড়ে থাকতে চান না নারী ফুটবলাররা। বাঘিনীদের লক্ষ্য এখন আরও বিশাল। আর তাইতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপার আনন্দ পাশে রেখে সপ্তাহ না পেরোতেই আবারও অনুশীলনে মত্ত হয়ে পড়েন কৃষ্ণা রাণী, সাবিনা খাতুন, মাসুরা পারভীন, রুপনা চাকমারা। নারী ফুটবলের যে জাগরণে দেশ পেয়েছে আনন্দের সেরা উপলক্ষ্য, সেই জাগরণের গানে ভেসে নারী ফুটবলাররা যেতে চায় বহুদূর। যে স্বপ্নের সীমানা নির্ধারণ করুক বাংলাদেশের স্বপ্নবাজ বাঘিনীরা।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সাফ জয়ী অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলকে সংবর্ধনা