প্রভার গায়ে হাত দিলেন কে, এই প্রশ্নটার উত্তর জানা জরুরি। এই প্রশ্নটার উত্তর জানা না গেলে দুটো পাশাপাশি চলা পেশাজীবী মানুষেরা অস্বস্তিতে ভুগবেন।
তার আগে জেনে নিই, এই গায়ে হাত দেওয়ার ব্যাপারটা কী!
সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে ইতোমধ্যেই অনেকে জেনে গেছেন, অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভা সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন, সাংবাদিকেরা তার প্রাইভেসি নষ্ট করছেন। আরও একধাপ এগিয়ে, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘যৌন হয়রানির’র অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
কোনো নারীর ‘গায়ে হাত দেওয়ার’ অভিযোগ মূলত যৌন হয়রানি। এদেশে নারীরা সরাসরি ‘যৌন হয়রানি’ না বলে ‘গায়ে হাত দেওয়া’ শব্দগুলো ব্যবহার করেন।
শুরুতেই প্রাইভেসি নিয়ে আলোচনা করি।
দুনিয়াজুড়ে শোবিজ তারকাদের ‘প্রাইভেসি’ এক চর্চিত শব্দ। শোবিজ তারকারা সাধারণ মানুষের কাছে, ভক্তদের কাছে পূজনীয় ব্যক্তি। ভক্তরা যেমন প্রিয় তারকাকে ভালোবাসেন, তেমনি প্রিয় তারকার হাঁড়ির-নাড়ির খবর পেতে উদগ্রীব থাকেন। আর এই হাঁড়ির-নাড়ির খবর সরবরাহ করে থাকেন সাংবাদিকেরা। এটাই তাদের পেশা।
সঙ্গত কারণেই পেশাজীবী হিসেবে সাংবাদিক এবং শোবিজ পারফরমার একে অন্যের পরিপূরক।
কিন্তু গোলযোগ বাঁধে তখনই যখন কোনো সাংবাদিক তারকার হাঁড়ির খবর বের করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রভার বর্ননাকৃত ঘটনার উল্লেখ করা যায়।
প্রভা মেকআপ রুমে বসে সাজগোজ করছেন। ঠিক তখনই একজন রিপোর্টার এবং ফটো সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত হন। প্রভার মেকআপের সময় ফটো সাংবাদিক তার কিছু ছবি তুলে ফেলেন। তখনই গোলযোগ বাঁধে। প্রভা ছবি তোলার কারণ জিজ্ঞেস করলে ওই ফটো সাংবাদিক উত্তর দেন—আমি তো সাংবাদিক!
লক্ষ্য করুন, প্রভার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে, ওই ফটো সাংবাদিক তার অনুমতি না নিয়েই ছবি তোলা শুরু করেছিলেন। এটা স্বাভাবিক সৌজন্যতার পরিপন্থী। সাংবাদিকতার চর্চাতেও এটাকে স্বাভাবিক মনে করার সুযোগ নেই।
ফটো সাংবাদিক প্রশ্ন করতে পারেন, তারকাদের ছবি তো আমরা হামেশাই তুলছি। প্রায়শই তারকারা ফটো সাংবাদিক দেখলে ছবি তোলার জন্য আগ্রহী হয়ে পোজ দেন। তাহলে আমার দোষটা কোথায়?
একজন শোবিজ তারকা নিজেকে যেভাবে সবার সামনে দেখাতে চান, মেকআপ করার মুহূর্তটি তেমন না। হয়তো তিনি চান না, তার অসম্পূর্ণ মেকআপের ছবি কেউ দেখুক। এটাই প্রাইভেসি। শিল্পী নিজের যা কিছু সাধারণের কাছ থেকে আড়াল রাখতে চান, তাকেই ‘প্রাইভেসি’ কোটের মধ্যে রাখেন। তার এই চাওয়ায় কোনো অন্যায় নেই।
কিন্তু পেশাজীবী হিসেবে একজন সাংবাদিকের চ্যালেঞ্জও ঠিক এখানেই। তার চাই নতুন খবর। গরম খবর। এ জন্য প্রাইভেসি লঙ্ঘন করার এক ‘আনঅফিসিয়াল বৈধতা’ তার থাকে। সে কারণেই শোবিজ তারকাদের কাছে ‘পাপারাজ্জি’ এক সুপরিচিত নাম।
তবে সাংবাদিক তার ‘আনঅফিসিয়াল বৈধতা’ কখন, কিভাবে প্রয়োগ করবেন— সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টিকটু, ত্রুটিপূর্ণ কার্যক্রম সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে বেমানান।
প্রাইভেসি প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলি।
শিল্পী যখন সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তখন তিনি অনেকাংশেই সাধারণের সম্পদে পরিণত হন। শিল্পীরাও এই ‘তত্ত্ব’ স্বীকার করেন।
ভক্তরা তার প্রিয় তারকার লাইফ স্টাইলকে অনুসরণ করেন। অনেক সময় প্রিয় তারকার জীবন-দর্শনকেও আদর্শ মানেন। এমন পরিস্থিতিতে তারকাদেরও সমাজের প্রতি এক ধরনের দায়িত্ববোধ তৈরি হওয়া উচিত। সাধারণত সেটা হয়ও।
যাহোক, শোবিজের শিল্পীরা যেহেতু ভক্তদের কাছে স্বপ্নের মানুষ, সুতরাং তাদের নিয়ে ভক্তদের আগ্রহ সীমাহীন হওয়ারই কথা। সেই সীমাহীন আগ্রহ মেটাতেই সাংবাদিকদের ছুটোছুটি। কারো যদি প্রাইভেসি রক্ষার প্রয়োজন খুব বেশি হয়ে থাকে, তাহলে সাংবাদিকদের গ্রিনরুমে এলাউ না করাই উচিত।
আপনি কতটা কাছে ঘেঁষতে দিবেন, তার সীমারেখা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে। তা না করতে পারলে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের অভিযোগ বিশ্বজুড়ে তারকাদের চর্বিত চর্বনের মতোই শোনা যাবে।
প্রভার দ্বিতীয় অভিযোগটি যৌন হয়রানির।
কোনো এক সাংবাদিক তার কাছে লিফট চেয়ে গাড়িতে পাশাপাশি বসেছিলেন এবং কোনো এক সময় প্রভার ‘গায়ে হাত’ দিয়ে বসেন।
যেকোনো নারীর জন্য ঘটনাটা অমর্যাদার। শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও অমর্যাদার। সেখানে পাশাপাশি দুটো পেশাজীবীর মধ্যে এমন ঘটনার গুরুত্ব আরও বেশি।
সাংবাদিকতা মহান পেশা। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে শোবিজ তারকারা ‘মি টু’ নামের এক আন্দোলন শুরু করেছেন। সাংবাদিকেরা সে আন্দোলনের সহযোদ্ধা। কিন্তু খোদ সাংবাদিকের বিরুদ্ধেই যখন এমন অভিযোগ ওঠে, তখন নড়েচড়ে বসার দরকার বৈকি। না হলে মহান পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা কলঙ্কিত হবে। মানুষের শ্রদ্ধার পেশাটি বিতর্কিত হবে। একই সঙ্গে শোবিজ শিল্পী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে এক ধরনের বিব্রতকর সম্পর্ক সৃষ্টি হবে।
সুতরাং সাংবাদিক এবং শোবিজ শিল্পী উভয়েরই নিজেদের স্বার্থে প্রভার এই অভিযোগ গুরুত্বসহ খতিয়ে দেখা উচিত। তদন্ত করা উচিত। কোনো সাংবাদিক যদি সত্যিই প্রভাকে যৌন হয়রানি করে থাকেন, তাকে খুঁজে বের করা উচিত। তার বিচার হওয়া উচিত।
বর্তমান সময়ে যারা শোবিজ অঙ্গনে সাংবাদিকতা করছেন, তারা যথেষ্ঠ মেধাবী এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। নিজেদের পেশার মান ভুলুণ্ঠিত হতে নিশ্চয়ই তারা দেবেন না। কিংবা সহযাত্রী শোবিজ শিল্পীদের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হোক, সেটাও চাইবেন না। আশা করি, তারাই এগিয়ে আসবেন প্রভার ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে।
সোহেল অটল: সাংবাদিক ও লেখক
atol.bd@gmail.com