যে পাঁচটি প্রশ্ন মায়েদের অবশ্যই করা উচিত
মা দিবস। সামাজিকমাধ্যমে দেখলাম, ‘এই দিনে ফেসবুকে আম্মা আম্মা না করে বাস্তবে আম্মাদের সময় দিতে, তাদের কাছাকাছি থাকতে।’ পোস্ট পড়ে হাইলি মোটিভেটেড হয়ে আম্মার কাছে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি, আম্মা ডালঘুটনি দিয়ে ডাল নাড়ছেন। কাজের সময়, এখন আম্মাকে জ্বালানো মানেই ঘুটনিটা হাঁড়ি ছেড়ে সোজা আমার কপালে চলে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। নাহ, এই ভুল করা যাবে না। সিদ্ধান্ত বদলে আম্মার রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায় মন দিলাম।
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় অপেক্ষা করা। এই মুহূর্তে আমাকে সেই কঠিন কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, আম্মার জন্য। কারণ, ফেসবুকের ওই পোস্ট আমার মাথায় গেঁথে গেছে— ‘আম্মাদের সময় দিতে হবে।’ কর্মব্যস্ত হওয়ার কারণে আম্মাকে অত সময় দেওয়া হয় না আমার। আজ দেব, পুরো সময়টাই আজ আম্মার জন্য বরাদ্দ। ঠিক কয়েক হাজার কোটি বছর পর আম্মার ডাল রান্না শেষ হলো। সারা ঘরে ডালের ম ম ঘ্রাণ। চোখ বুজে ঘ্রাণ অনুভব করলাম। আশ্চর্য, ডালেও আম্মা আম্মা গন্ধ!
ছোটবেলায় আম্মার আশেপাশে ঘুরঘুর করা আমার একমাত্র কাজ ছিল। বড় হয়ে নানান ঝুট-ঝামেলায় আম্মার আশেপাশে ঘুরঘুর করার অবকাশ আর আমি মেলাতে পারিনি। আম্মাও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এই দূরত্বে। আজ এত বছর পর এই ঘুরঘুর করাতে আম্মা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। আম্মার মন হয়তো বুঝে ফেলেছে, কোন এক অভিসন্ধিতে আমার এই আগমন। আম্মা পাত্তা দিলেন না। আগে খেয়ে নিতে বললেন।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে আম্মার সামনে বসে আছি। বসে আছি বললে ভুল হবে। সূক্ষ্ম চোখে আম্মাকে পরখ করছি। কিছু প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে। ভাবছি, করব কি করব না। আম্মার চেহারায় অবশ্য শরতের শুভ্রতা ভর করেছে। কোনো কারণে হয়তো তার মন ভালো। কিন্তু প্রশ্নগুলো করার পর কালবৈশাখীর মেঘ ভর করবে কি না, এ ব্যাপারে আগাম পূর্বাভাস আমি অন্তত সন্তান হয়ে দিতে পারছি না। আম্মাদের এই এক বৈশিষ্ট্য। ষড়ঋতুর প্রত্যেকটা রূপ যেন তাদের দেখেই শিখেছে কখন কেমন ব্যবহার করা উচিত।
তবে এই মুহূর্তে আমার হাত-পা কাঁপছে। কথা ফোটার পর থেকেই আম্মাকে কোটি কোটি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেছিলাম আমরা ভাই-বোনরা। আম্মাকে কাছে বেশি পাওয়ার কারণেই এই অধিকারটা আমাদের তীব্র ছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, আম্মাকে প্রশ্ন করার অধিকার আছে আমাদের। আমাদের ছেলেবেলার একমাত্র জ্ঞানভাণ্ডার ছিলেন আম্মা। ছিলেন বলছি কেন, এখনও আছেন।
আব্বার সাথে ছোট থেকেই সখ্যতা কম থাকার কারণে আম্মার কাছেই আমাদের সব আবদার। তবুও প্রশ্নোত্তর পর্ব নিয়ে আম্মাকে এখনও ভয় পাই। আমার ভয় পাওয়া আম্মা টের পেয়ে গেছেন হয়তো। ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘যা বলার বইলা ফালা।’ সাহস পেয়ে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, ‘প্রথম প্রশ্ন, আম্মা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? একদম সত্য বলবা।’
আম্মা আকাশের দিকে তাকালেন। আমি খেয়াল করলাম, আমার আম্মার চোখে বয়সের ছাপ। কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল। এত গভীরভাবে কতকাল দেখি না আম্মাকে? আম্মার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি আম্মার দিকে। আম্মা হাসিমুখেই বললেন, ‘তোরা তিন ভাইবোনই আমার অর্জন, পড়াশোনা করে যে এতদূর এসেছিস এইটাও অর্জন।’
‘দ্বিতীয় প্রশ্ন, আম্মা তোমার কেমন লাগছিল যখন আমরা হইছি?’ আম্মার মুখভর্তি হাসি। দাঁত কেলিয়ে হাসি না, আম্মার চোখ হাসছে। দুনিয়ার সুন্দরতম দৃশ্য চোখের সামনে দেখার জন্য মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেললাম আমি। সেই হাসি নিয়েই আম্মা বলে উঠলেন, ‘তোদের দুই বোনের জন্মের সময় আমি অতটা বুঝি নাই। তবে ছোটটা হওয়ার আগে বুঝছিলাম। অনেক ভালো লাগছিল।’
একটু জানিয়ে রাখি, আমরা দুই বোন, এক ভাই। ভাই ছোট। আমি মেজো। ছোট ভাইটাকে আব্বা-আম্মা দুজনেই যে চোখে হারান সে আমরা দু’বোন হাড়ে হাড়ে টের পাই। আগে খুব ঈর্ষা হতো, কেন আম্মা ওকেই বেশি ভালোবাসেন। এখন হয় না। বরং আম্মা-আব্বা ওকে কিছু বললে মনে হয় আমাদের দুই বোনের গায়েই লেগে গেল সবটা। আমি আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে তৃতীয় প্রশ্নটি করলাম, ‘আচ্ছা আম্মা, তোমার জীবনে কোনটাকে ব্যর্থতা হিসেবে নেবে?’
এই প্রশ্নে আম্মাকে একটু হতাশ মনে হলো। প্রশ্ন করে ভুল করলাম না তো? অনুতপ্ত হচ্ছিলাম। কেন যে ট্রেন্ডে গা ভাসাতে গেলাম। এক জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর না জানলে তো ক্ষতি নেই।
তবে আম্মা মুখ খুললেন কিছু বলার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘আমি ঠিক অন্য মায়েদের মতো হইতে পারি নাই। সন্তানকে নাকি পারসোনাল স্পেস দেওয়া লাগে। অথচ, আমি তোদের হাতড়ায়া না পাইলে আমার দুনিয়া অন্ধকার লাগে। এই স্পেস হয়তো আমি কোনোদিনও দিতে পারব না তোদের।’
কী সহজ স্বীকারোক্তি! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি আম্মার দিকে। এই মায়ের সন্তান আমি। আহা! কোনো পদক না পেলেও চলবে জীবনে কিন্তু একজন মা অবলীলায় তার ব্যর্থতার গল্প করছেন সন্তানের কাছে, আর সন্তান হয়ে আমি সে গল্প বসে থেকে শুনছি। আমার জীবনে প্রাপ্তির খাতা এখানে বন্ধ হলেও আফসোস থাকবে না আর। একটা তৃপ্তির হাসি বের হলো আমার। টেনে একটা নিশ্বাস নিয়ে চতুর্থ প্রশ্নটি করলাম আম্মাকে, ‘আমাদের ভাইবোনদের কোন দিকটায় বেশি কষ্ট পাও তুমি?’
এইবার আম্মা ফর্মে চলে এলেন। চেহারায় বিরক্তিভাব ফুটে উঠেছে তার। এভাবেই আম্মা বলতে শুরু করলেন, ‘তোরা তিনটা তিন রকম। বড়টা সামান্য ব্যাপারে এত চিন্তা করে, বিরক্তিকর। নিশ্চিত হইতে পারে না কিছুতে। তুই যখন রাগ করোস, বেশি করোস। যখন করোস না, পাত্তাই দেস না। ছোটটার অভিমান, অভিযোগ, জেদ সবই বেশি। হবেই তো, বংশের রক্ত আছে না শরীরে!’
এই পর্যায়ে এসে আমি ঘর কাঁপিয়ে হেসে দিলাম। দোষগুলো সব বংশের আর গুণগুলো সব মায়ের দিকের। আজকাল এই-ই সই, আম্মা যেহেতু বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। তবে প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে আমি আম্মাকে দেখে নিচ্ছিলাম বারবার। আম্মার অস্বস্তি হচ্ছে কি না, আমার প্রশ্নে কষ্ট পাচ্ছেন কি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে আম্মা অনেক সাবলীল ছিলেন এই প্রশ্নোত্তরের সময়ে। সাহস পেয়ে শেষ প্রশ্নটি ছুড়লাম, বলো তো আম্মা, আমাদের ভাইবোনের কার ওপর তুমি কী কী কারণে খুশি?
আম্মা আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে গালভরে হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, তোরা তিনটা হইছিস তিন রকমের। তোর আপা অনেক বাধ্যগত। নিজের কষ্ট হইলেও তোর আব্বা আর আমার কথা মাথায় রাখে, হাসিমুখে মানিয়ে নেয় সবটা। ওর কাছে সবার আগে ওর বাপ-মায়ের খুশি।
আম্মা না জানালেও আপার এই গুণ সম্পর্কে আমি জানি। আপা আম্মার কার্বনকপি। আম্মার সবকয়টি ভালো গুণ নিয়ে আপা দুনিয়াতে এসেছেন, এটা আমার বিশ্বাস। এমন আপা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবতী। কিন্তু আম্মা এখনও আমার আর আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু বলেননি। আমি আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আরও কিছু শোনার জন্য। অবশেষে আম্মা মুখ খুললেন, ‘তুই অনেক বাস্তববাদী, সংসারের অনেক কিছু বুঝোস, খেয়াল রাখোস। সংসারের অনেক সিদ্ধান্তে তোর আব্বাকে পাইনাই আমি। তার ব্যস্ততা আকাশচুম্বী। কিন্তু তুই ছিলি। আমার যেকোনো সিদ্ধান্তহীনতায় তোরে আমি পাশে পাইছি।
এই পর্যায়ে দৌড়ে আসা কান্নাটা সন্তর্পণে গিলে নিলাম। আমি ভাবতাম, আম্মা বোধহয় আমাকে খেয়ালই করেন না। কিন্তু তিনি তার তিন সন্তানকেই যে এত খেয়াল করেন, এটা আমার কল্পনার বাইরে। তবে প্রশ্নগুলো আমার জানা জরুরি। দরকার পড়লে প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে আম্মার গলা ধরে কাঁদব। কিন্তু এখন না।
আম্মা আবার বললেন, তোদের ভাইটাকে নিয়া আমার গর্ব হয়, অহংকার না। এই বয়সের ছেলে অনুযায়ী ও অনেক ভদ্র আছেরে। আল্লাহ যেন আমার সব কয়টা ছেলেমেয়েরে আজীবন এমনই রাখেন, আমিন। আমিন। আমিন। আল্লাহ যেন আমার আম্মার সন্তানদেরকে আজীবন এমনই রাখেন।
মাঝে মাঝে অনেককে আফসোস করতে শুনি। আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদতে দেখি, ‘মায়ের কাছ থেকে এটা জানা হলো না, ওটা জানা হলো না, মা-কে একবার জড়িয়ে ধরা হলো না’! ছোট একটা জীবন আফসোসের ভারেই তো বিশাল হয়ে যায়। বলি, এত আফসোস রেখে কী হবে? এক জীবনে কী আছে আর? মা পাশে আছে, দেখছেন, ছুঁতে পারছেন, ঘ্রাণ পাচ্ছেন, কথা শুনতে পারছেন।
একটু না-হয় জেনেই নিন আপনাকে ঘিরে আপনার মায়ের না-বলা কথা। কিছু মুহূর্ত জমা হোক মায়ের সাথে। সাথেই তো আছে, শুধু একটু কদর করতে হবে বৈ কি! হারালে চোখের জল ফেললে উসুল হবে কিছু?
মন্তব্য করুন