যেভাবে ঢাকা থেকে হারালো ২০০ বছরের ভিস্তি পেশা
ভিস্তি আবে ভিস্তি, এ রকম হাঁকিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি সরবরাহ করা এখন যেন রূপকথার গল্প। মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো ভেজা গামছা। এসবই একসময় ছিল ভিস্তিওয়ালাদের প্রতিচ্ছবি। মুঘল সম্রাটের সময় থেকেই ছিল এর চর্চা। জানলে আশ্চর্য হবেন, এক ভিস্তিওয়ালা পুরো মুঘল সাম্রাজ্য শাসনের মুকুট পেয়েছিলেন দান হিসেবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভিস্তি কি? এবং ভিস্তিওয়ালাই বা কীভাবে মুঘল সম্রাটের জীবন বাঁচিয়ে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন শাসন মুকুট?
একসময় প্রতিদিন চামড়া দিয়ে তৈরি পাত্র মশক ভরে দুইবেলা পানি শহরের বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হতো। আর যারা দিয়ে যেতেন সেসব পানিওয়ালাদের বলা হতো ভিস্তিওয়ালা। কালো মেষের পেটের মতো চামড়ার এসব মশক পিঠে বয়ে আনতেন ভিস্তিওয়ালারা। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিতেন মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর ৷
ভিস্তিওয়ালা ও তাদের স্থান কারা দখল করেছে সে সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই জানেন না।
কথায় আছে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না। তেমনি পানির তৃষ্ণাও যেন অন্য কিছুতে মেটে না। তাই সবসময় হাতের কাছেই পানি রাখা ছাড়া উপায় কি? আর বর্তমানে পানি সরবরাহের বড় মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র ও বোতল। এখন যেমন ভ্যানে করে বাসা-বাড়ি কিংবা অফিস আদালতে বিতরণ হয় পানির জার, ঠিক ওই সময়টাতে পানি বিতরণে একমাত্র ভরসা ছিল শহরের ভিস্তাওয়ালারা।
ভিস্তিওয়ালাদের কাঁধে থাকা পানিভর্তি চামড়ার ব্যাগই ছিল মূলত ভিস্তি। যা ছিল ছাগলের চামড়ার তৈরি বিশেষ এক ধরনের ব্যাগ। এটি মশক নামেও পরিচিত ছিলো। এ মশকে যিনি জল বহন করে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছে দিতেন তাকে বলা হতো ভিস্তিওয়ালা।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় দেখা যেতো ভিস্তিওয়ালাদের আনাগোনা। ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতোই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার ওপর। নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হতো। সেইসময় ভিস্তিওয়ালারাই তাদের কাছে থাকা একটি চামড়ার বিশাল মশকে করে পানি সরবরাহ করতেন বাড়িতে বাড়িতে। তাদেরকে সুক্কাও বলা হতো।
বর্তমানে পুরান ঢাকার যে সিক্কাটুলি দেখা যায় তা ছিল ভিস্তিওয়ালাদের এলাকা। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা বেশির ভাগই ছিল সুন্নি মুসলিম। মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে তাদেরকে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে দেখা যেতো।
এই ভিস্তিওয়ালারা বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। যুদ্ধের সময় তারা তাদের বিশেষ পানির ব্যাগ মশক নিয়ে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করতেন।
একবার মুঘল সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুন কোনো এক যুদ্ধে আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক খরস্রোতা নদীতে। জলের প্রচণ্ড স্রোতে যখন হুমায়ুনের প্রাণ যায় যায়, তখন এক ভিস্তিওয়ালা তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। হুমায়ুন তাকে কথা দিয়েছিলেন, যদি কখনও তিনি সিংহাসনে বসতে পারেন, ওই ভিস্তিওয়ালা যা উপহার চাইবেন, তাই দেবেন।
পরে যখন হুমায়ুন সম্রাট হলেন, তখন সেই ভিস্তিওয়ালা তার কাছে চেয়ে বসলেন সম্রাটের সিংহাসন। বাদশাহ হুমায়ুন নিজের মুকুট পরিয়ে দিলেন ভিস্তিওয়ালার মাথায়, তাকে বসালেন নিজের সিংহাসনে। তখন ভিস্তিওয়ালা সম্রাটকে আলিঙ্গন করে ফিরিয়ে দিলেন তার মুকুট আর সিংহাসন।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় একসময়ের ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক এ পেশা হারিয়ে এখন শুধু ঠাঁই হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
মন্তব্য করুন