বাবার টাকা নেই, তাহলে কীভাবে হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডে পড়ব! আমার মেধা বলতে কিচ্ছু নেই, আমাকে দিয়ে হবে না! অফিসে আমার বসার জায়গা নেই। আমার কম্পিউটার ঠিকমতো কাজ করে না। কীভাবে আমি অফিসকে ভালো কাজ উপহার দেব? অমুক কাজ আমাকে দিয়ে হবে না, কারণ, আমার ফিটনেস নেই। আমি দেখতে সুন্দরি নই, তাই বিয়েটা বুঝি আর হবে না। সবকিছুতে সবাই তাচ্ছিল্য করে, বেঁচে থেকে আর লাভ কী!
এ ধরনের নানান কথা আমাদের মনে আসে, বলেও থাকি। কখনও কখনও অপমান আর লাগাতার ব্যর্থতার ভার সইতে না পেরে শেষে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিই। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে ফেলি। একতরফা কি না, সেটাও ভেবে দেখি না। সারাজীবন নিঃসঙ্গ থাকার মতো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিই। কখনও কখনও নিজেকে পৃথিবী থেকে নির্মমভাবে বিদায় করে দিই। অথচ আমরা একটি বারের জন্যও ভেবে দেখি না যে, মেঘের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে সূর্য! বজ্রপাতের পর নেমে আসে শান্তির বৃষ্টি!
চলতি বছরের মে মাসে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রীর বরাতে জানানো হয়েছিল; সরকারের কাছে মাত্র পাঁচ কোটি ডলারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশিষ্ট রয়েছে। করোনা মহামারি ও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতিতে ধস নেমেছে।
শ্রীলঙ্কার অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়েছে যে, দেশটির সরকার হিমশিম খাচ্ছে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতে। ঋণের জন্য শরণাপন্ন হচ্ছে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, চীন ও ভারতসহ অন্যান্য দাতাদের কাছে। ইতোমধ্যে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দেশটি। যা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ঘটনা। দেশটির শেয়ারবাজারেরও শোচনীয় অবস্থা।
খাদ্য, তেল ও বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটের প্রতিবাদে গত এপ্রিলে গোতাবায়া সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশটিতে শুরু হয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা হয়। একপর্যায়ে মে মাসে সরকারি-বেসরকারি খাতের কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় দেশটির হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, দোকানপাট।
বিক্ষোভের মুখে এপ্রিল মাসেই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে নমল রাজাপক্ষসহ মন্ত্রিসভার ২৬ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। তাদের পদত্যাগেও দেশটিতে ফিরে আসেনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
৯ মে দিনভর সংঘর্ষের পর পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরও শান্তি ফিরে আসেনি শ্রীলঙ্কায়। অব্যাহত ছিল হামলা ও পাল্টা হামলা। সংঘর্ষ ও বিক্ষোভ। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ হয়েছিল যে, সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজের পিস্তল দিয়ে নিজেই আত্মহত্যা করেছিলেন।
সবশেষ কোনো উপায় না পেয়ে ১৩ জুলাই দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পরিবারসহ মালদ্বীপে পালিয়ে যান।
প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের দপ্তর দখল করে নেয় বিক্ষোভকারীরা। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিক্ষোভকারীরা সেলফি তুলে উল্লাস করে।
এর আগে ৯ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করে নিয়েছিল বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীরা সেখানে ঘুমিয়েছিল। প্রাসাদের রাজকীয় নার্সারি থেকে চারাগাছ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। প্রাসাদের জিমে কসরত করেছিল অনেক বিক্ষোভকারী।
একটা দেশের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সাধারণ মানুষের দখলে চলে গেলে, বুঝতে বাকি থাকে না রাজনৈতিক অবস্থা কতোটা অস্থিতিশীল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকলে, জনগণের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
দেশের এমন টালমাটাল আর অস্থিতিশীল অবস্থার মাত্র এক মাসের মাথায় এশিয়া কাপ ক্রিকেট খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল।
২৭ আগস্ট এশিয়া কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে ৮ উইকেটে হেরে এশিয়া কাপের যাত্রা শুরু করল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু মনোবল হারাননি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা।
এরপর সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ মনোবল চাঙা করে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নামে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশকে পরাজিত করে। উঠে যায় সুপার ফোরে।
পরবর্তীতে সুপার ফোরে আফগানিস্তানকে আর জেতার সুযোগ দেয়নি তারা। এমনকি ফাইনালে খেলা নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও সুপার ফোরে পাকিস্তানকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়নি শ্রীলঙ্কা। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে।
সবশেষ ১১ সেপ্টেম্বর এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ৬ষ্ঠ বারের মতো এশিয়া কাপের শিরোপা জিতল শ্রীলঙ্কা।
এ লেখার মাধ্যমে পাঠককে যে বার্তা দেওয়া উদ্দেশ্য তা হলো- জীবনের কোনো অবস্থাতে ঘাবড়াতে নেই। ভেঙে পড়তে নেই। সবসময় নিজেকে নিজে এই মোটিভেশন দেওয়া যে, আজ খারাপ অবস্থা তো কাল ভালো হবে। আজ আমি ফকির তো কাল আমির হবো। আজ আমি ব্যর্থ হয়েছি, কাল বিজয়ী হবো। আজ পারিনি, কাল অবশ্যই পারব। আজ হয়নি, কাল হবেই। যদি নিজেকে এবং অন্যকে এভাবে মোটিভেশন দিতে পারতাম আমরা, তাহলে দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ত না। মানসিক রোগীর তালিকা দীর্ঘ হতো না। দুঃখের বিষয় হলো, আমরা নিজেকে বা অন্যকে এমন মোটিভেশন দিই না। ফলে দেশে বাড়ছে আত্মহত্যা ও মানসিক রোগী।
নিচে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো-
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, সবশেষ ২০২০ সালের জরিপে দেখা যায় প্রতি লাখে ৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেন। ওই সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যা ধরা হয় ১৭ কোটি ১৬ লাখ। ২০২০ সালে সারাদেশে মোট ১৩ হাজার ৮১৪ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গড় প্রায় সমান।
করোনা পরবর্তী সময়ে বেড়েছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা। ঠুনকো কারণে আত্মহত্যা করেছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। জাতীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত মাত্র ৮ মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয়েছে প্রেমঘটিত কারণে।
সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, ৩৬৪ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১৯৪ জনই ছিল স্কুলগামী শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আত্মহত্যার প্রবণতা নারী শিক্ষার্থীদের চেয়ে পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি। অবস্থান বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৮-১৯ অনুসারে, দেশে ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ শতাংশ শিশুর কোনো না কোনো মানসিক রোগ রয়েছে।
২৪ আগস্ট ২০২১ সালে ব্র্যাক আয়োজিত ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কৌশল’ শীর্ষক ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে বলা হয়েছিল, দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা পৌনে দুই কোটি।
নাটোরের খুবজিপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহার একজন শিক্ষার্থীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। এ খবর গণমাধ্যমে এসেছিল। অধিকাংশ মানুষ তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। গালমন্দ করেছিল শিক্ষিকাকে। দুঃখ ও ক্ষোভে ১৪ আগস্ট আত্মহত্যা করেন তিনি।
কী প্রয়োজন ছিল শিক্ষিকাকে গালমন্দ বা তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করার? আমাদের অবুঝের মতো আচরণে মানসিক রোগী হয়ে যায় অনেক মানুষ। আত্মহত্যা করেন অনেকে।
শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা দেশের এতো খারাপ অবস্থার পরও বিশ্বকে নিজেদের সাফল্য দেখালো। হার দিয়ে এশিয়া কাপ ক্রিকেট শুরু করেও চ্যাম্পিয়ন দিয়ে খেলা শেষ করল।
আসুন, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের থেকে মোটিভেশন নিয়ে নিজেরা বদলে যাই এবং অন্যদের বদলে দিই। পরিস্থিতি যতো খারাপই হোক ভেঙে না পড়ি। কাউকে ভেঙে পড়ার সুযোগ না দেই। যখন নিজের অবস্থা খারাপ হবে তখন নিজেকে মোটিভেশন দেব। যখন অন্যের অবস্থা খারাপ হবে তখন তাকে মোটিভেশন দিয়ে খারাপ অবস্থা থেকে বের করে আনব। মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মানিসকতা থেকে বিরত থাকি। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে শুরু করি।